mahishadal rath yatra
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের রথযাত্রা (mahishadal rath yatra) বাংলার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতহ্যবাহী ঐতিহাসিক ধর্মীয় উৎসব। প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি পুরনো এই রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং বাংলার ইতিহাস, শিল্পকলা ও সামাজিক সংহতির এক জীবন্ত নিদর্শন হিসাবে পরিচিত।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
মহিষাদল রথযাত্রার (mahishadal rath yatra) সূচনা হয় ১৭৭৬ সালে, মহিষাদল রথযাত্রার সূচনা হয় ১৮০৫ সালে তৈরি করেছিলেন মহিষাদল রাজবংশের রানি জানকী দেবী। ১৭৭৪ সালে তিনি মদনগোপাল জিউ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং রথযাত্রার পরিকল্পনা করেন। তবে তার জীবদ্দশায় রথযাত্রা শুরু হয়নি। ১৮০৫ সালে রাজবংশের মতিলাল পাঁড়ে (উপাধ্যায়) প্রথম রথযাত্রার আয়োজন করেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা।
রথের বৈশিষ্ট্য
মহিষাদলের রথটি (mahishadal rath yatra) সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এবং এর উচ্চতা প্রায় ৫৫ ফুট তাছাড়া কলস ও ধ্বজা সহ ৭০ ফুট। রথের চাকাগুলো লোহার পাত দিয়ে মোড়া, যার প্রতিটির ব্যাস ১২ ফুট। প্রথমদিকে রথে ১৭টি চূড়া থাকলেও পরবর্তীতে তা ১৩টিতে সীমিত করা হয়। রথে জগন্নাথ দেব ও রাজবাড়ির শালগ্রাম শিলা শ্রীধর জিউ-এর মূর্তি স্থাপন করা হয়। প্রথম রথ নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৬৪,০০০ টাকা, যা তখনকার সময়ে বিপুল অর্থ ছিল।
রথযাত্রার আগের দিন “নেত্র উৎসব” বা “লেদ উৎসব” পালন করা হয়, যেখানে রথের রশি বাঁধা হয়। এই রসি বাঁধার মাধ্যমে এই উৎসব শুরু হয়। রথ টানার সূচনা হয় রাজপরিবারের বর্তমান সদস্য পালকিতে চড়ে এসে প্রথম রশি টানেন এবং তোপধ্বনির মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়। রথটি মহিষাদল শহীদ বেদি থেকে গুণ্ডিচাবাটি পর্যন্ত প্রায় ১.৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। রথ টানার জন্য চারটি রশি থাকে যার মধ্যে একটি কেবল মাত্র শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত, যা নারীদের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
মহিষাদল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনার্দন উপাধ্যায় যিনি উত্তরপ্রদেশের একজন ব্রাহ্মণ ব্যবসায়ী ছিলেন। ষোড়শ শতকে মুঘল আমলে তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাংলায় আসেন এবং মহিষাদল অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে বসবাস শুরু করেন। তিনি তৎকালীন স্থানীয় রাজা কল্যাণ রায়চৌধুরীর কাছ থেকে মহিষাদলের জমিদারি কিনে নেন। রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়, তিনি ছিলেন জনার্দন উপাধ্যায়ের বংশধর। তার সময়ে মহিষাদলে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক উন্নতি ঘটে। তার স্ত্রী রানি জানকী দেবী ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী, যিনি মহিষাদলে রথযাত্রার পরিকল্পনা করেছিলেন।
মতিলাল পাঁড়ে ছিলেন আনন্দলাল ও রানি জানকীর পোষ্যপুত্র। তিনি ১৮০৫ সালে মহিষাদলে প্রথম রথযাত্রার আয়োজন করেন।রাজা লছমনপ্রসাদ গর্গ ১৮৬০ সালে তিনি রথের নকশা পরিবর্তন করেন এবং ফরাসি কারিগর মঁসিয়ে পেরুর সহায়তায় রথের সংস্কার করেন। তাছাও রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ, তিনি রথের সামনে দুটি সাদা ঘোড়ার মূর্তি যোগ করেন এবং রথের শোভা বৃদ্ধি করেন। হরপ্রসাদ গর্গ বর্তমানে তিনি রাজপরিবারের প্রধান হিসেবে মহিষাদল রথযাত্রা (mahishadal rath yatra) ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
মেলার সাংস্কৃতি
রথযাত্রা উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে, যেখানে স্থানীয় শিল্প ও কৃষিপণ্যের সমারোহ দেখা যায়। হস্তশিল্প হস্ত শিল্প হিসেবে পুতুল, বেতের সামগ্রী, সবং-এর বিশেষ বিখ্যাত মাদুরও দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও কাঁঠাল, জিলিপি, তেলেভাজা, পাঁপড়। পায়রা ও অন্যান্য পাখির হাট। একসময় এই মেলায় যাত্রাপালা, কীর্তন, পালাগান ও মৃৎশিল্প প্রদর্শনী হত, যদিও বর্তমানে এর প্রভাব কিছুটা কমেছে। বর্তমানে রথযাত্রার নিরাপত্তা ও পরিচালনার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বহন করে।
উপসংহার
মহিষাদল রথযাত্রা (mahishadal rath yatra) বাংলার সাংস্কৃতিক heritage-এর একটি অমূল্য সম্পদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর রূপ কিছুটা বদলালেও, এটি এখনও লক্ষাধিক মানুষের বিশ্বাস, ঐক্য ও উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। এই রথযাত্রা শুধু পূর্ব মেদিনীপুরের গর্ব নয়, সমগ্র বাংলার অহংকার।